মঙ্গলবার, ১২ অগাস্ট ২০২৫, ০৬:৫০ অপরাহ্ন
মুহাম্মদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ:
সুন্দর ও সুস্থ জীবনের জন্য প্রয়োজন দেহ ও প্রাণের উপযুক্ত খাবার। আত্মার পরিচর্যার মাধ্যমে যেমন সুস্থ মন-মস্তিষ্ক গড়ে ওঠে, তেমনি পর্যাপ্ত খাবারের মাধ্যমে দেহ হয়ে ওঠে সজীব ও সবল। আল্লাহর বিধিনিষেধ লঙ্ঘনের মাধ্যমে মানুষের অন্তরে দানা বাঁধে দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা, হিংসা, ভয়, লোভ-লালসা ছাড়াও আত্মার অন্যান্য রোগব্যাধি। তাই ইসলামে রুগ্ণ আত্মার যেমন প্রতিষেধক আছে, তেমনি সুস্থ ও সুন্দর জীবনের জন্য আছে খাবারের সুশৃঙ্খল নীতিমালা। মানুষের জীবন গঠনে খাবারের ভূমিকা খুবই স্পষ্ট। আর আত্মা ও দেহ রুগ্ণ হয়ে উঠলে মানুষ হারিয়ে ফেলে নিজের আসল পরিচয়। জীবন হয়ে ওঠে মরীচিকাময়।
ইসলাম বিশ্বমানবতার জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাই তো বৈধ পন্থায় জীবিকা অর্জন এবং আহারকে ইবাদতের মানদণ্ড হিসেবে সাব্যস্ত করেছে ইসলাম। খাদ্যের জোগান ও সুষম বণ্টনের অপরিসীম। হালাল জীবিকা উপার্জন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও পরিশ্রম ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই বৈধ পন্থা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী খাদ্য উৎপাদনে মিলবে হালাল উপার্জন। আর তাতে খাদ্য ঘাটতির অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে দেশ ও জাতি।
খাদ্যের চাহিদা মেটাতে ফসল উৎপন্ন ও সংরক্ষণ করতে হবে। খাদ্য উৎপাদনে পরিকল্পনা ও সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও সময় মতো বীজ বপন করতে হবে। তাতে উৎপন্ন হবে খাদ্য। মহান আল্লাহ মানুষকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘তোমরা যে বীজ বপন করো, তা সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কী? তোমরা সেটা উৎপন্ন করো, নাকি আমি উৎপন্নকারী? আমি ইচ্ছে করলে সেটা খড়কুটোয় পরিণত করে দিতে পারি। (তা করলে) তখন তোমরা অবাক হয়ে যাবে।’ (সুরা ওয়াকিয়া ৬৩-৬৫) অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনি পৃথিবীকে স্থাপন করেছেন সৃষ্ট জীবের জন্য। এতে আছে ফলমূল আর রসযুক্ত খেজুর বৃক্ষ এবং খোসাবিশিষ্ট দানা ও সুগন্ধি গুল্ম।’ (সুরা আর রহমান ১০-১২)
এ কারণে দুনিয়াতে যত নবী-রাসুলের আগমন ঘটেছে তাদের সবাই খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। নিজেরা যেমন কৃষিকাজ, পশুপালন করতেন ঠিক তেমনি খাদ্যশস্য উৎপাদনের মাত্রা কীভাবে বাড়ানো যায় সে ব্যাপারে তাদের অনুসারীদেরও দিয়েছেন নানা উপদেশ ও পরামর্শ। এমনকি হজরত আদম, ইবরাহিম, লুত, শুয়াইব (আ.)-সহ প্রায় সব নবী-রাসুলই পশুচারণ, দুধবিক্রি, কৃষিকাজ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে খাদ্যের চাহিদা মিটিয়েছেন। বিশেষ করে প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.)-ও নিজ হাতে খেজুরগাছ রোপণ করে খাদ্য উৎপাদনের অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। বৃক্ষরোপণ ও খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে দিয়েছেন যুগের সর্বোত্তম পরামর্শ। খাদ্যের চাহিদা মেটাতে প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে কৃষিকাজে উৎসাহিত করেছেন। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা জমিনের প্রচ্ছন্ন ভাণ্ডারে খাদ্য অম্বেষণ করো।’
মহান আল্লাহ দুনিয়ায় মজুদকৃত খাদ্য ভাণ্ডার থেকে নিজেদের খাদ্য চাহিদা মেটাতে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘যখন নামাজ শেষ হয়ে যায় তখন তোমরা জীবিকার অন্বেষণে (খাদ্য উৎপাদনের জন্য কাজ-কর্মে) পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো।’ (সুরা জুমা ১০)
প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) উম্মতের জন্য খাদ্যের মজুদ বাড়াতে এবং অভাবমুক্ত রাখতে সব পরিত্যক্ত বা অনাবাদি জমিতে চাষাবাদের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘তোমরা জমি আবাদ করো। আর যে ব্যক্তি নিজে জমি আবাদ করতে না পারে, সে যেন ভূমিটিকে তার অন্য ভাইকে দিয়ে দেয়, যাতে সে ওই জমি আবাদ করে ভোগ করতে পারে।’
আলোচ্য বিষয়ে ইসলামি শিক্ষাগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সুস্বাস্থ্যের জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করা। কেননা মানুষ যত খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করুক না কেন যদি মহান আল্লাহ সেগুলো শরীরের জন্য কল্যাণকর না বানান তাহলে এই খাদ্য গ্রহণ কোনো কাজেই আসবে না। তদ্রুপ সুখাদ্য খেলেই যে শরীর ভালো থাকবে এবং শক্তি সামর্থ্য বাড়বে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। যদি মহান আল্লাহ এ খাদ্যকে খাদ্য গ্রহণকারীর উপকারী না করে দেন। তাই প্রকৃত উপকার প্রদানকারী প্রভুর কাছে সুস্বাস্থ্যের জন্য দোয়া করা আবশ্যক। রাসুল (সা.) উম্মতকে এই শিক্ষা দিয়েছেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘একদিন রাসুল (সা.) বললেন, আজান ও ইকামতের মাঝের দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। এ কথা শুনে আনাস (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা তখন কী দোয়া করব? তিনি বললেন, আল্লাহর কাছে দুনিয়া ও আখেরাতের সুস্থতা ও নিরাপত্তা কামনা করবে।’ (জামে তিরমিজি)
খাদ্য ও পণ্যে ভেজাল না দিতে সরকারের নানা পদক্ষেপ অব্যাহত রয়েছে। তারপরও কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে আমরা যদি সবাই পরিপূর্ণ মুসলিম হওয়ার দৃঢ় সংকল্প করি, আশা করা যায়, তাহলে সমাজ থেকে ভেজাল অনেকটাই দূর হয়ে যাবে। কারণ একজন প্রকৃত মুসলিমের গুণ সম্পর্কে হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুসলমান বলা হবে ওই ব্যক্তিকে, যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে এবং মুমিন হলো ওই ব্যক্তি, যার পক্ষ থেকে অন্য মানুষের প্রাণ ও সম্পদের কোনো শঙ্কা না থাকে। (সহিহ বুখারি) মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে খাদ্যপণ্যে ভেজাল মেশানো থেকে বেঁচে থাকার তওফিক দান করুন এবং আমরা সবাই যেন মুসলিম হিসেবে অন্য মুসলিম ভাই-বোনের ক্ষতির কারণ না হই।
ভয়েস/আআ